স্টাফ রিপোর্টার
দরিদ্র পিতার সন্তান। থাকতেন গ্রামের কাঁচা বাড়িতে। কোন কাজকর্ম নেই তাই বেকার। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর পাল্টে যায় দৃশ্যপট। নিয়োগ বাণিজ্য দিয়ে শুরু হলেও এখন পুরোদস্তুর ব্যবসায়ী। বিশাল বিত্তবৈভবের জীবন। হয়েছেন জনপ্রতিনিধিও। কামিয়েছেন শতকোটি টাকার অবৈধ সম্পদ। রাজধানী ঢাকায় অত্যাধুনিক ফ্ল্যাট, প্লট, ময়মনসিংহে মুরগির খামার আর সুনামগঞ্জ শহরে বিলাসবহুল এ্যাপার্টমেন্ট, বাসাবাড়ি তো আছেই। গুণধর ওই ব্যক্তির নাম মো. আজাদ হোসেন (৪৭)। তিনি সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার বালিজুরী ইউনিয়ন পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান এবং সুনামগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের কার্যকরী কমিটির সদস্য। গতকাল রোববার দুপুরে দুর্নীতি দমন কমিশন দুদক’র সিলেট বিভাগীয় কার্যালয়ে তার অবৈধ সম্পদের বিষয়ে অভিযোগ দেয়া হয়েছে।
অবৈধ সম্পদের পাহাড় …..
জানা গেছে, সুনামগঞ্জ পৌর শহরের মরাটিলা এলাকায় ২১ শতক ভূমির উপর বিলাসবহুল ৬ তলা ভবন নির্মাণ করেন ওই চেয়ারম্যান। ওই ভূমির প্রতি শতকের দাম ১০ লাখ টাকা। ভূমিসহ এই এ্যাপার্টমেন্টের দাম প্রায় ২৫ কোটি টাকা। সুনামগঞ্জ শহরের নতুনপাড়া, হাসননগরসহ শহরের বিভিন্ন এলাকায় তার নিজের ও পরিবারের অন্য সদস্যদের নামে বাসাবাড়ি ও জমি আছে। নিজ এলাকা তাহিরপুরের মাহতাবপুরে গ্রামের বাড়ির নিকটে গেল ৫ বছরে স্ত্রীর নামে ৫০ একর জায়গা ক্রয় করেন। ওই জায়গার দাম ১০ কোটি টাকা। অথচ, তার স্ত্রী একজন গৃহবধূ। গৃহবধূর আয়-রোজগারের কোনো সুযোগ নেই। তাহিরপুর উপজেলা সদরে বহুল আলোচিত ব্যবসায়ী প্রয়াত হাজী জয়নাল আবেদীনের দোকান ২ কোটি টাকায় তিনি কিনে নেন। ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলায় ২০ একর জায়গার উপর গড়ে তুলেছেন মোরগ ও ডিম উৎপাদনের খামার। ওই খামারের দাম ২০ কোটি টাকারও বেশি।
সিলেট সদর উপজেলার বলাউড়া এলাকায় সিলেট-সুনামগঞ্জ মহাসড়কের পাশে একটি সিএনজি-পেট্রোল পাম্প নির্মাণাধীন রয়েছে। রাজধানী ঢাকার সেগুনবাগিচায় একটি অত্যাধুনিক ফ্ল্যাট ও ঢাকায় দুটো প্লট আছে।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, আজাদ হোসেন এতোটাই প্রভাবশালী যে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার শাসনামলে কেউ ভয়ে তার বিরুদ্ধে মুখ খুলতে সাহস করেননি। ছাত্র জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর এই প্রথম সিলেট অঞ্চলের কোনো রাঘববোয়ালের বিরুদ্ধে সরাসরি দুদকে লিখিত অভিযোগ করা হল। চেয়ারম্যান মো. আজাদ হোসেনের (৪৭) দুর্নীতির সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্তপূর্বক তাকে আইনের আওতায় নিয়ে আসতে দুদকের নিকট দাবি জানিয়ে আবেদনে তার সম্পদের মোটামুটি একটা ফিরিস্তিও তুলে ধরা হয়েছে। তবে সূত্র বলছে, বাস্তবে আজাদ চেয়ারম্যানের অবৈধ সম্পদের পরিমাণ আরও অনেক বেশি।
হিন্দু সম্প্রদায়ের জমি দখল করে ক্রাশার মিল স্থাপন …..
২০২২ সালে কালো টাকার জোরে প্রভাব খাটিয়ে প্রথমবারের মতো স্থানীয় বালিজুরী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন তিনি। চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পরই তাহিরপুরের আনোয়ারপুর বাজারের নিকটস্থ নোয়াহাট এলাকায় হিন্দু সম্প্রদায়ের আড়াই একর জায়গা দখল করে নেন। এরপর দখলকৃত জায়গায় স্থাপন করেন পাথর ভাঙ্গার ক্রাশার মিল। বর্তমানে এই ক্রাশার মিলকে কেন্দ্র করে ১০ কোটি টাকারও বেশি দামের পাথর স্টক করা হয়েছে। প্রকাশ্যে ওই জমি দখল করা হলেও ভয়ে কেউ প্রতিবাদ করার সাহস পাননি। জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য হয়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের জমি দখল করলেও সুনামগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগ কিংবা কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের কেউ তার বিরুদ্ধে কোনো টুশব্দ টুকুও করেননি।
আছে জলমহালের নিয়ন্ত্রণও …..
কেবল অবৈধ সম্পদে ক্ষান্ত হননি আজাদ। বৃহৎ জলমহালের নিয়ন্ত্রণও নেন। তিনি জামালগঞ্জ উপজেলার সদরপুর জলমহালটি প্রতি বছর
প্রতি বছর ২ কোটি টাকায় তিনি ইজারা নিয়েছেন। এছাড়াও তাহিরপুর, মধ্যনগর ও জামালগঞ্জ উপজেলার মধ্যে বহমান মুকসেদপুর জলমহালটি বছরে ৯৮ লাখ টাকায় এবং তাহিরপুর উপজেলার মাটিয়ান হাওর জলমহাল বছরে ৬০ লাখ টাকায় তিনি ইজারা নিয়েছেন। এছাড়াও আরও বহু জায়গায় তার নামে-বেনামে সম্পদ রয়েছে। এক কথায় আজাদ হোসেন গড়ে তুলেছেন অবৈধ সম্পদের পাহাড়।
কে এই আজাদ চেয়ারম্যান …..
মো. আজাদ হোসেন তাহিরপুর উপজেলার মাহতাবপুর গ্রামের দরিদ্র পরিবারের সন্তান। তার পিতার নাম আব্দুল হান্নান। পিতা-মাতার ৩ পুত্র ও ৪ কন্যা সন্তানের মধ্যে আজাদ হোসেন ২য়। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকারে আসার পূর্ব পর্যন্ত তার পিতার ৩ একর আমন জমি ও ২৮ শতক জমির উপর তাদের বসতবাড়ি ছিল একমাত্র সম্বল। কিন্তু স্বৈরাচার শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর গেল ১৬ বছরে এই আজাদ হোসেন এখন শতকোটি টাকার অবৈধ সম্পদের মালিক।
চাঁদা নিতেন স্থল বন্দর থেকেও …..
বাংলাদেশ স্থলবন্দর শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদকের প্রভাব খাটিয়ে প্রতিটি স্থল বন্দর থেকে এক সময় নিয়মিত চাঁদা নিতেন। আর টাকার বিনিময়ে ভাগিয়ে নেন জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য পদ। স্থল বন্দর পানামা হ্যান্ডলিং কোম্পানির একজন পরিচালক তিনি। এই কোম্পানির পরিচালক হিসেবে তার মাসিক বেতন ৭০ হাজার টাকা। রাজধানী ঢাকার শান্তিনগরে স্থল বন্দর শ্রমিক লীগের অফিস নিয়েছেন আজাদ। তিনি নিয়মিত অফিসে বসেন এবং বেশিরভাগ সময় ইউনিয়নবাসীকে সেবা না দিয়ে ঢাকায় বসবাস করছেন। উচ্চ আদালতে বিভিন্ন মামলার তদবিরও করেন। ছিলেন ৪ মামলার আসামিও।
সুরঞ্জিতের কালো টাকার গুঞ্জন …..
সুনামগঞ্জ-২ আসনের সংসদ সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ২০১২ সালে রেলমন্ত্রী হওয়ার পর রেলপথ মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন পদে নিয়োগ দিতে এই আজাদ হোসেন তিন লাখ টাকা করে ১০০ জনের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নেন। কিন্তু রেলপথ মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতি ফাঁস হয়ে গেলে ওই নিয়োগ বাতিল হয়ে যায়। লোকজনের বহুচাপে কিছু মানুষের টাকা ফেরত দিলেও অধিকাংশ মানুষের টাকা আত্মসাত করেন আজাদ। এই আজাদের ব্যাংক এ্যাকাউন্টে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের কালো টাকা বছরের পর বছর ধরে পড়ে আছে বলে এলাকায় গুঞ্জন আছে।এছাড়াও ২০১৬ সালে সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার ধোপাজান নদীর বালুমহাল সম্পূর্ণ অবৈধ পন্থায় তিনি ইজারা নেন। জনৈক জাকির হোসেন বিষয়টি নিয়ে উচ্চ আদালতে রিট করলে আজাদের লিজ বাতিল করে কয়েক কোটি টাকা জরিমানাও আরোপ করেন। ২০১৮ সালে ফাজিলপুর বালুমহালে ৭১ হেক্টর জায়গার ইজারা নেন। কিন্তু তিনি তার ব্যবসায়ীক পার্টনার ফেরদৌস আলমকে হটিয়ে শুধুমাত্র আওয়ামী লীগের একচ্ছত্র প্রভাব খাটিয়ে বহুল আলোচিত জিয়াউল ও সেলিমকে অংশীদার বানান। পরবর্তীতে জাদুকাটা নদীতেও সম্পূর্ণ অবৈধভাবে বালু তুলেন।
অবশেষে দুদকে অভিযোগ …..
হঠাৎ করে কোন আলাদীনের চেরাগ পেলেন আজাদ যে, সামান্য একটা দরিদ্র পরিবারের সন্তান হয়ে মাত্র ১৬ বছরে শতকোটি টাকার অবৈধ সম্পদের মালিক হলেন এমন প্রশ্ন এলাকার সাধারণ লোকজনের মুখে মুখে। তার দুর্নীতি, অবৈধ ক্ষমতার-বল প্রয়োগের সঠিক তদন্ত করে তাকে দেশের প্রচলিত আইনের মুখোমুখি করতে দুদকের নিকট রেজাউল হক নামের এক ব্যক্তি লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। দুই পৃষ্ঠার এই লিখিত অভিযোগে আজাদ চেয়ারম্যানের অবৈধ সম্পদের বিস্তর বর্ণনা দেয়া হয়েছে। অভিযোগকারী রেজাউল সিলেটের ডাককে বলেন, আজাদ চেয়ারম্যানের অবৈধ সম্পদ গড়ে তোলার বিষয়টি রীতিমতো বিস্ময়কর। সঠিক তদন্ত হলে তার দুর্নীতির বহু তথ্য বেরিয়ে আসবে। তিনি এসকল দুর্নীতি ও অবৈধ সম্পদ গড়ে তোলার বিচার দাবি করেন।
আজাদ চেয়ারম্যানের বক্তব্য …..
এ সকল অভিযোগের বিষয়ে জানতে চেয়ে গতকাল সন্ধ্যায় সিলেটের ডাক’র বার্তা কক্ষ থেকে আজাদ চেয়ারম্যানের সেলফোনে একাধিকবার কল দেয়া হলেও তিনি কল রিসিভ করেননি। তবে, তিনি একাধিক সংবাদপত্রের নিকট দাবি করেছেন অভিযোগগুলো মিথ্যা এবং উদ্দেশ্য প্রণোদিত। তার ইনকাম ট্যাক্সের ফাইলে এসকল সম্পদ বিবরণী উল্লেখ আছে। তিনি অবৈধভাবে কিংবা দুর্নীতির মাধ্যমে সম্পদ গড়ে তুলেননি।